সূরা গাফির: আয়াত ২১-২৫ (পর্ব-৬)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্বে সূরা গাফির বা মু'মিনের ২১ নম্বর থেকে ২৫ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ২১ ও ২২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
أَوَلَمْ يَسِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَيَنْظُرُوا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الَّذِينَ كَانُوا مِنْ قَبْلِهِمْ كَانُوا هُمْ أَشَدَّ مِنْهُمْ قُوَّةً وَآَثَارًا فِي الْأَرْضِ فَأَخَذَهُمُ اللَّهُ بِذُنُوبِهِمْ وَمَا كَانَ لَهُمْ مِنَ اللَّهِ مِنْ وَاقٍ (21) ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ كَانَتْ تَأْتِيهِمْ رُسُلُهُمْ بِالْبَيِّنَاتِ فَكَفَرُوا فَأَخَذَهُمُ اللَّهُ إِنَّهُ قَوِيٌّ شَدِيدُ الْعِقَابِ (22)
“এরা কি ভূপৃষ্ঠে বিচরণ করে না? করলে দেখত তাদের পূর্বে যারা ছিল তাদের পরিণাম কেমন হয়েছিল। তারা এদের চেয়ে শক্তিতে এবং কীর্তিতে ছিল প্রবলতর। তারপর আল্লাহ্ তাদেরকে তাদের অপরাধের জন্য পাকড়াও করলেন এবং আল্লাহর শাস্তি থেকে তাদেরকে রক্ষাকারী কেউ ছিল না।” (৪০:২১)
“এটা এ জন্য যে, তাদের কাছে তাদের রাসূলগণ স্পষ্ট প্রমাণাদিসহ আসতেন কিন্তু তারা কুফরি করত। ফলে আল্লাহ্ তাদেরকে (শাস্তি দিতে) পাকড়াও করলেন। নিশ্চয় তিনি শক্তিশালী, শাস্তিদানে কঠোর।” (৪০:২২)
এই দুই আয়াতে মানুষকে অতীত জাতিগুলোর ইতিহাস সম্পর্কে গবেষণা করার আহ্বান জানিয়ে বলা হচ্ছে: যারা অতীতে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বসবাস করত এরা কেন তাদের পরিণতির দিক তাকায় না? তাকালে দেখতে পেত নিজেদের অপরাধের কারণে তাদের কত ভয়াবহ পরিণতি হয়েছিল।
এখানে বলা হচ্ছে: মানুষ যদি পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করে তাহলে তারা এমন কিছু প্রাসাদ ও দূর্গের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাবে যা অতীতের কোনো জাতি তৈরি করেছিল। এসব দূর্গে অত্যাচারী শাসকেরা বসবাস করত; কিন্তু আজ ভূপৃষ্ঠে তাদের কোনো অস্তিত্ব অবশিষ্ট নেই। এসব ধ্বংসাবশেষ আমাদের জন্য এই শিক্ষা বহন করে যে, অত্যাচারী শাসকেরা যত বড় প্রতাবশালী ক্ষমতার অধিকারী হোক না কেন এভাবে একদিন তাদেরকেও চলে যেতে হবে।
পরের আয়াতে আল্লাহ বলছেন: আমি মানুষকে সৎপথে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব পালন করেছি এবং তাদের কাছে নবী-রাসূল পাঠিয়েছি। কিন্তু তারা সৎপথ গ্রহণ না করে কুফরি করেছে এবং নবী-রাসূলদের প্রত্যাখ্যান করেছে। এ কারণে তারা আল্লাহর ক্রোধের শিকার হয়। অথচ তারা কখনো ভাবতেই পারেনি তাদের চেয়ে বড় কোনো শক্তির অস্তিত্ব রয়েছে; যে শক্তি তাদের ক্ষমতা ও আধিপত্যের দম্ভ চূর্ণ করতে পারে।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- পবিত্র কুরআনে অতীত জাতিগুলোর ইতিহাস জানার জন্য শিক্ষা সফর করতে উৎসাহ দেয়া হয়েছে।
২- বর্তমান সময়ে পথ চলার জন্য অতীত জাতিগুলো পরিণতি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা বুদ্ধিমানের কাজ।
৩- মহান আল্লাহ পাপী ব্যক্তিদেরকে শুধু পরকালেই শাস্তি দেবেন না। এই দুনিয়াতেও তিনি তাদেরকে শাস্তির কিছু নমুনা প্রদর্শন করেন।
৪- কাউকে সতর্ক না করে তাকে শাস্তি দেয়া আল্লাহ তায়ালার রীতি নয়।
সূরা গাফির বা মুমিনের ২৩ ও ২৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا مُوسَى بِآَيَاتِنَا وَسُلْطَانٍ مُبِينٍ (23) إِلَى فِرْعَوْنَ وَهَامَانَ وَقَارُونَ فَقَالُوا سَاحِرٌ كَذَّابٌ (24)
“আর অবশ্যই আমি আমার নিদর্শন ও স্পষ্ট প্রমাণসহ মূসাকে প্রেরণ করেছিলাম,”(৪০:২৩)
“ফেরাউন, হামান ও কারুনের কাছে। কিন্তু তারা বলল, সে চরম মিথ্যাবাদী জাদুকর।”(৪০:২৪)
এই দুই আয়াতে বলা হচ্ছে: মহান আল্লাহ হযরত মূসা (আ.)কে অলৌকিক নিদর্শনসহ ফেরাউনের মতো অত্যাচারী শাসক, তার উজির হামান এবং তখনকার ধনকুবের কারুনের কাছে পাঠান। হযরত মূসা আল্লাহর ইচ্ছায় এসব ব্যক্তির সামনে কিছু অলৌকিক নিদর্শন প্রকাশ করে তাদেরকে একথা বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, তাঁর সঙ্গে সৃষ্টিকর্তার সংযোগ রয়েছে। অলৌকিক নিদর্শনের পাশাপাশি হযরত মূসার সঙ্গে ছিল কিছু শক্ত দলিল-প্রমাণ। কিন্তু জালেম শাসক ফেরাউন এসব নিদর্শনকে নিছক যাদু বলে উড়িয়ে দেয় এবং হযরত মূসার নবুওয়াতপ্রাপ্তির ঘটনাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে।
এই ঘটনা যে কেবল ফেরাউন হযরত মূসা (আ.)’র সঙ্গে ঘটিয়েছে তা নয় বরং যুগে যুগে সব নবী-রাসূলের সঙ্গে তাদের জাতির লোকেরা এ কাজ করেছে। হযরত মূসাকে আল্লাহ পাঠিয়েছিলেন জালিম শাসক ফেরাউনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে ন্যায়বিচারপূর্ণ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু তাঁর দাওয়াতের বাণী গ্রহণ করলে ফেরাউন ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের পক্ষে জনগণের ওপর আর অত্যাচার চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো না এবং তাদের ক্ষমতার ভিতও নড়ে উঠত। কাজেই অবৈধ শাসন টিকিয়ে রাখতে তারা কঠোর হাতে হযরত মূসা (আ.) ও তাঁর সঙ্গীদের দমন করার সিদ্ধান্ত নেয়।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- নবী-রাসূলগণ মানুষকে আল্লাহর একত্ববাদের দিকে আহ্বান করেই দায়িত্ব শেষ করেননি বরং তারা অত্যাচারী শাসনব্যবস্থার পতন ঘটানোরও চেষ্টা করেছেন।
২- সম্পদের প্রাচুর্য ও ক্ষমতার দম্ভ অনেক সময় মানুষকে আল্লাহর মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করায়।
৩- নবী-রাসূলদের মোজেযা বা অলৌকিক নিদর্শন সবার কাছে স্পষ্ট হলেও দুনিয়াপ্রীতি ও আত্মম্ভরিতার কারণে একদল মানুষ তা মেনে নিতে চায় না।
এই সূরার ২৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:
فَلَمَّا جَاءَهُمْ بِالْحَقِّ مِنْ عِنْدِنَا قَالُوا اقْتُلُوا أَبْنَاءَ الَّذِينَ آَمَنُوا مَعَهُ وَاسْتَحْيُوا نِسَاءَهُمْ وَمَا كَيْدُ الْكَافِرِينَ إِلَّا فِي ضَلَالٍ (25)
“অতঃপর মূসা আমার নিকট থেকে সত্য নিয়ে তাদের কাছে উপস্থিত হলে তারা বলল, যারা মূসার সাথে ঈমান এনেছে, তাদের পুত্র সন্তানদের হত্যা করো এবং তাদের নারীদেরকে জীবিত রাখো। কিন্তু কাফিরদের ষড়যন্ত্রের পরিণতি ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছু নয়।” (৪০:২৫)
হযরত মূসা (আ.)’র অলৌকিক নিদর্শন ও স্পষ্ট দলিল দেখার পর ফেরাউন ও তার উজির হামানের বলার আর কিছু থাকে না। কিন্তু তারপরও তারা সত্য মেনে না নিয়ে ক্ষমতার দম্ভ দেখায়। এই আয়াতে ফেরাউন ও হামানের কিছু কুচক্রি পরিকল্পনার কথা বলে দিয়েছেন আল্লাহ তায়ালা। প্রথমে তারা হযরত মূসার প্রতি ঈমান আনা পুরুষ ও যুবকদের হত্যা করে তাদের নারীদেরকে দাসী হিসেবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল, এরইমধ্যে যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়া এবং আর যাতে কেউ ঈমান গ্রহণ না করে সেজন্য ভয়াবহ আতঙ্ক তৈরি করা।
এ ধরনের নির্মম হত্যাকাণ্ড ইতিহাসে যুগে যুগে অসংখ্যবার ঘটেছে। মানুষকে সত্যবিমুখ করার জন্য অত্যাচারী শাসকদের এটা ছিল অন্যতম বড় হাতিয়ার। তবে ফেরাউনের এই ষড়যন্ত্র ও কুচক্রি পরিকল্পনা রিসালাতের দায়িত্ব পালন থেকে হযরত মূসাকে বিরত রাখতে পারেনি। আল্লাহ তায়ালা ফেরাউনের অত্যাচারী শাসনের হাত থেকে হযরত মূসা (আ.)’র জাতি বনি-ইসরাইলকে রক্ষা করেন।
এ আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:
১- ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় বিরোধী পক্ষের ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ ও তাদেরকে কারাগারে নিক্ষেপ করা ছিল অত্যাচারী শাসকদের অভিন্ন বৈশিষ্ট্য।
২- প্রকৃত ঈমানদারগণ অত্যাচারী শাসকদের চাপের সামনে মাথানত করেন না বরং ঈমানি বলে বলীয়ান হয়ে সামনে এগিয়ে যান।
৩- ইসলামের শত্রুরা সব সময় সৎপথে থাকা জনগোষ্ঠীকে বিপথগামী করতে চায়। কিন্তু ঈমানদারগণ যদি দ্বীনকে সহযোগিতা করে তাহলে শত্রুদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয় এবং অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের বিজয় হয়। এটি আল্লাহ তায়ালার অলঙ্ঘনীয় প্রতিশ্রুতি।#
পার্সটুডে/এমএমআই/এআর/৩১
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।